আমি সুন্দর সোনালি শৈশব উপভোগ করেছি কিনা নিশ্চিত না, তবে শৈশবটা উল্লেখযোগ্য না আমার কাছে। উল্লেখযোগ্য সেই সিদ্ধান্তগুলো- আমার এবং আমার চারপাশের মানুষদের- যা আমাকে আজকের পরিস্থিতিতে এনেছে। সিদ্ধান্তগুলো বালুরাশির মতো স্তরে স্তরে সেজে আমাদের একেক জীবন মরুর রূপ দেয়। আমার জীবন মরুভূমির মতোই। এখানে একসময় সুবিশাল ও বিস্তর জলরাশি থাকলেও, এখন আর নেই। তাতে আমার বিশেষ কোনো আফসোস নাই কারণ মরুভূমিরও নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। আর জীবন এখানেও থেমে থাকে না। জীবন এখানে লুকোচুরি খেলে আলো-আধারের সাথে, আর্দ্রতা-শুষ্কতার সাথে। জীবন থেমে থাকে না।
আমার দেখা অধিকাংশ জিনিসই আমি ভুলে গেছি। আর সেগুলো মনে করার ব্যাপারেও আমি খুব একটা সচেষ্ট না। যা গেছে, গেছে। কিন্তু আমি ফেলে আসা ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে ভুলি নাই। আমার অভিজ্ঞতা ক্রমবর্ধমান আর অভিজ্ঞতার শিক্ষা স্কাল্পচারের মতো চিরনির্মানাধিন। শিক্ষার শেষ নাই- অন্তত এতটুকু আমি শিখেছি। একটা দাগ টানা দরকার আমি মনে করি পুথিগত ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা ও অনুধাবনমূলক শিক্ষার মধ্যে। দাগটা অনেকসময় ঘোলাটে আমার বেলায়। কারণ আমার শিক্ষার অনেক বড় একটা অংশই আসে আমার কল্পনার সাথে বাস্তবতার সংঘর্ষ থেকে। আমি ধারণা গড়ি আর ভাঙ্গি। কারণ কোনো চরমই পরম না। আজকের সত্য কালকে ধোঁয়াটে, পরশু তা মিথ্যে আর তার পরেরদিন শুধুই রূপকথা। ছোট থাকতে পাইলট, আর্মি, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী আরও অনেক কিছুই হতে চেয়েছি। এখন সব একই লাগে। ভিতরে একই মানুষ খালি বাইরে ভিন্ন ভিন্ন ট্যাগ লাগানো। আমার দৃষ্টিভঙ্গি অমূলক হতে পারে, কিন্তু আমি তো কৈফিয়ত দিচ্ছি না কাউকে।
সময়ের সাথে এটাও বুঝতে পেরেছি, একদিন আমি জীবনের জয়জয়কার ঢোল পেটানোর জন্যও আর জীবিত থাকবো না। এটা পরে ভাবার চেয়ে আগে ভাবাটাই আমার কাছে বেশি দরকারি মনে হয়। আমি প্রায়ই বলতে শুনেছি- এতকিছু করে লাভ কি যদি একদিন মরেই যাই? প্রশ্নের উত্তর যদি প্রশ্নের মধ্যেই থাকে, সেটা ভালো প্রশ্ন না। 'একদিন' মরার চিন্তায় আমি আমার 'একটা দিন' তো নষ্ট হতে দিতে পারি না। প্রতিটা দিনই আমার শেষ দিন হতে পারে, হলে হোক। আমি জীবনকে যদি বরণ করতে পারি, মৃত্যুকেও বরণ করার ভারও তো আমার উপরই ন্যস্ত হয়। আমার ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট নাই। আমি মরার পরের কথা মরার আগে ভাবি না। ঠিক যেমন একটা শিশু জন্মের পরের কথা জন্মের আগে ভাবে না। ভবিষ্যতের অভিজ্ঞতা কি বর্তমানে অর্জন করা যায়? গেলে কি আর সেটাকে 'অভিজ্ঞতা' বলতো? নাকি পাগলের প্রলাপ বলতো? যাই হোক, আমি যেহেতু আপাতত জীবিত, আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।
শেষ করার আগে একটা নক্ষত্রের জীবনাবসানের বর্ণনা দেই। আমাদের সূর্যের মতো একটা নক্ষত্র উদ্দেশ্যহীনভাবেই অজস্র কোটি বছর নিজে জ্বলে আলো দিয়ে যাবে। তারপর একদিন হঠাৎ করেই একটা প্রবল বিস্ফোরণ দিয়ে নিহারিকার সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তু হিসেবে কয়েক মুহূর্ত থেকে নিস্তব্ধ হয়ে যাবে। আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো কৃতজ্ঞতা না বুঝতে পারা একটা বস্তুর কাছে।
২০.০৩.২৫
- মি. আহমেদ
Comments
Post a Comment